পুরুষ ও নারী

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৫) - খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - | NCTB BOOK
31
31

সপ্তম অধ্যায়

পুরুষ ও নারী

কেউ যখন আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে তখন আমরা সচরাচর আমাদের নাম ও বংশ পরিচয় দিয়ে

থাকি । কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই এর চাইতে বড় একটি পরিচয় আছে । আর তা হলো আমরা প্রত্যেকেই মানুষ । ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেককেই মনুষ্যত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন নিজের প্রতিমূর্তিতে, পুরুষ ও নারী করে । আমরা নারী-পুরুষ হলেও আমাদের প্রত্যেকের সমান মর্যাদা ও অধিকার রয়েছে । সেই কারণে সবার প্রতি প্রেম বা ভালোবাসার মনোভাব পোষণ করা আমাদের প্রত্যেকেরই দরকার ।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-

ঈশ্বর কর্তৃক পুরুষ ও নারী হিসেবে মানুষ সৃষ্টির বিষয় বর্ণনা করতে পারব;

  • নারী-পুরুষের সুস্থ সম্পর্ক বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • নারী-পুরুষের সমতা ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • ভালোবাসা সম্পর্কে প্রেরিত পলের শিক্ষা বিশ্লেষণ করতে পারব এবং
  • নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল হবো ।

ঈশ্বরের সৃষ্টি পুরুষ ও নারী

আমাদের চারপাশের সমস্ত কিছু পরম করুণাময় প্রভু ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজেই ভালোবাসা এবং তাঁর নিজের এই ভালোবাসা দিয়ে তিনি পরম যত্নে সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন । অন্য সবকিছু সৃষ্টি করার পর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন । এই মানব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শুরু হলো পৃথিবীতে নরনারীর রহস্যময় ইতিহাস

ঈশ্বর মানুষের বাসযোগ্য করে এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু সৃষ্টি করার পর তাঁর আপন প্রতিমূর্তিতে ও আপন সাদৃশ্যে প্রথম মানব আদমকে সৃষ্টি করলেন এবং তাঁকে নিয়ে এদেন উদ্যানে রাখলেন। কিন্তু পরে এক সময় ঈশ্বর বললেন, মানুষের একা থাকা ভালো নয় । তাই ঈশ্বর তাঁরই মতো করে এমন আর একজনকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করলেন, যে তাকে সাহায্য করবে ও তার যোগ্য সঙ্গী হবে। তাই আদমের ওপর গভীর তন্দ্রার আবেশ নামিয়ে এনে তাঁর একটি পাঁজর খুলে নিয়ে তিনি তা মাংস দিয়ে ঢেকে দিলেন। আদমের বুক থেকে খুলে নেওয়া সেই পাঁজর দিয়ে ঈশ্বর একজন নারীকে গড়ে তুললেন । এরপর তাঁকে আদমের কাছে নিয়ে এলেন । আদম তাঁকে দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে বলে উঠলেন, এই হলো আমার অস্থির অস্থি, মাংসের মাংস । এর নাম নারী হবে, কেননা নরদেহ থেকেই তাকে তুলে আনা হয়েছে ।

ঈশ্বরের পরিকল্পনায় পুরুষ ও নারী

পুরুষ ও নারী করে মানুষকে সৃষ্টি করা ছিল ঈশ্বরের নিজস্ব পরিকল্পনা এবং একান্ত ইচ্ছা । এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে দুইটি দিক । একদিকে মানব ব্যক্তি হিসেবে পূর্ণ সমতা ও অন্যদিকে নিজ নিজ সত্তায় পুরুষ ও নারীরূপ । পুরুষ হওয়া বা নারী হওয়া হলো একটি সত্য যা ভালো ও ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রসূত । 

 

 

মানুষের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো--মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে গড়া । ঈশ্বর অনাদি অনন্ত । তিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন । সেই ঈশ্বর মানুষের মধ্যে দিয়েছেন অমর আত্মা । পবিত্র, ন্যায়বান, প্রেমময় ঈশ্বর মানুষের মধ্যেও দিয়েছেন পবিত্রতা, ন্যায্যতা ও ভালোবাসা । মানুষকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন সকল সৃষ্টির ওপর সেবা ও যত্ন করার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়ত, ঈশ্বর এক। নিজের প্রতিমূর্তিতে মানুষকে পুরুষ ও নারী করে সৃষ্টি করে তাদের দুইজনকে তিনি এক করেছেন ।

সকল সৃষ্টির পরে মানুষকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর দেখলেন, সকল সৃষ্টির দেখাশুনা করার জন্য তাঁর সহকর্মী প্রয়োজন । কারণ ঐ সৃষ্টিগুলো অন্যান্য সৃষ্টিকে তাঁর মতো করে দেখাশুনা করার যোগ্যতা অর্জন করেনি । ঐগুলো তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট ছিল না। মানুষকে সৃষ্টি করে ঈশ্বর তৃপ্ত হলেন । পূর্ণ তৃপ্তির জন্য ঈশ্বর মানুষের মধ্যে নিজের প্রতিমূর্তি, নিজের সাদৃশ্য দিলেন ।

শুরুতে ঈশ্বর শুধু একজন পুরুষ ও একজন নারী সৃষ্টি করেছেন । এর অর্থ এই যে, একজন পুরুষের মাত্র একজন স্ত্রী থাকবে এবং একজন নারীর একজন স্বামীই থাকবে । তারা দুইজনই ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে গড়া । এই কারণে দুইজনেই সমান মর্যাদার অধিকারী । ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ষষ্ঠ দিনে, সকল সৃষ্টি সমাপ্ত করার পর । এর অর্থ হলো, মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টজীব । সে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে গড়া হলেও ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্মে তার কোন হাত নেই । নিজের প্রতিমূর্তিতে গড়ে তাকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন সৃষ্টিকে দেখাশুনা করার ।

কাজ: জোড়ায় জোড়ায় বসে ঈশ্বরের সৃষ্ট পুরুষ বা নারী হিসেবে তুমি তোমার অনুভূতি সহভাগিতা করবে ।

নারী পুরুষের সুস্থ সম্পর্ক

সম্পর্ক হলো ভাবের আদান প্রদান । একজন মানুষ তার মনের ভাব বা ইচ্ছা অন্য একজন মানুষের কাছে প্রকাশ করবে, এটাই স্বাভাবিক । সুস্থ সম্পর্ক আমাদের সহায়তা করে সুন্দরভাবে ভাবের আদান প্রদান করতে । ভালো বা সুস্থ সম্পর্ক একে অন্যের আরও কাছাকাছি যেতে সাহায্য করে ।

আমরা জানি, মানুষ সামাজিক জীব । সমাজবদ্ধভাবে বাস করা তার স্বভাব । সমাজের সবার সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক থাকবে, সেটাই সকলে কামনা করে । কিন্তু সম্পর্কটা যখন দুই বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে হয়, তখন অনেকের বেলায় একটা অহেতুক ভয় বা দ্বিধা কাজ করে । এটা রক্ষণশীল সমাজে আরও বেশি হয় । এই কারণে আমাদের এই পর্যায়ে সুন্দর মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠতে হবে । আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, আমরা প্রত্যেকে একই ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছি।

নারী ও পুরুষ একই ঈশ্বরের সৃষ্টি । ঈশ্বর নারী ও পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন যা আমরা পূর্বেই জেনেছি । মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ এক হলেও শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে কিছু ভিন্নতা রয়েছে । একে অন্যের চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির মধ্যে সেই ভিন্নতা বেশি করে লক্ষ করা যায় । তাই নারী-পুরুষের সুস্থ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যেহেতু এই বিষয়গুলো বেশি প্রভাব বিস্তার করে তাই সব সময় সচেতন থাকতে হয় ।

নারী-পুরুষের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক বলতে সাধারণত: নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে বোঝায়: একে অন্যকে সম্মান করা বা মর্যাদা দেওয়া, বুঝতে পারা, একে অন্যের প্রয়োজনে ভাইবোনসুলভ মনোভাব নিয়ে

 

 

পাশে দাঁড়ানো, বন্ধুসুলভ মনোভাব পোষণ করা, দৈহিক লালসাকে নিজের আয়ত্বে রেখে মানবীয় দিকের প্রতি প্রাধান্য দেওয়া; একে অন্যের প্রতি দরদবোধ বা সহানুভূতি দেখানো । এসবের মধ্য দিয়ে একে অন্যের কাছাকাছি আসা ও ভাবের আদান প্রদান করা ।

নারী ও পুরুষের মধ্যে এ বিষয়গুলোর অভাব ঘটলে সেখানে আর সুস্থ সম্পর্ক থাকে না। তখন নারী পুরুষের সম্পর্কটা সীমাবদ্ধ হয়ে যায় শুধুমাত্র ভোগের মধ্যে। মানুষ তখন একে অন্যকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে । শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য একে অন্যকে ব্যবহার করে। তখন মানবীয় দিকটি বাদ পড়ে যায় বা তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন উচ্ছৃঙ্খলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে পরস্পরের মধ্যে দেখা দেয় সন্দেহ, স্বার্থপরতা, পারিবারিক ভাঙ্গন, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা বা অমর্যাদা ইত্যাদি । ফলে ঘটে নৈতিক

অবক্ষয়--যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা গোটা মানবতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এটা মানব জীবনে মোটেই কাম্য নয়। 

পারিবারিক বা দাম্পত্য জীবনে নারী পুরুষের সম্পর্ক

পারিবারিক বা দাম্পত্য জীবনে নারী-পুরুষের সুস্থ সম্পর্ক বলতে বিবাহিত জীবনের মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার সম্পর্ককে বোঝায় । ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করার পর বলেছেন, মানুষের একা থাকা ভালো নয়। আর তাই তাঁরই মতো করে আর একজনকে সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে তিনি স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছেন । তারা হৃদয়ের টানে একে অপরের কাছে আসে এবং প্রত্যেকে একে অপরের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করে । খ্রিষ্টভক্তদের জন্য তা একটি পবিত্র সাক্রামেন্ত যা গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রী ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করে । তারা তাদের ভালোবাসার দায়িত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টিকাজে তাদের নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে । কাজেই এই সম্পর্ক পবিত্র । এই সম্পর্কের মর্যাদা ও পবিত্রতা বজায় রাখা খ্রিষ্টীয় স্বামী-স্ত্রীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ।

কাজ: শ্রেণীকক্ষের কয়েকজন ভালো বক্তা নিয়ে “পুরুষ ও নারীর সুস্থ সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকাই অধিক” এই বিষয়ের ওপর বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে । যারা বিতর্কে অংশগ্রহণ করবে না তারা মন দিয়ে শুনবে ও পরে মতামত ব্যক্ত করবে ।

 

 

নারী পুরুষের সমতা

আমরা আগেই জেনেছি, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে ঈশ্বর তাঁর আপন প্রতিমূর্তিতে, আপন সাদৃশ্যে এবং পুরুষ ও নারী করে সৃষ্টি করেছেন । এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিটি মানুষকে স্ব-স্ব মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন । তাই পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোন ধরনের ভেদাভেদ বা পার্থক্য থাকতে পারে না । তারা সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে প্রত্যেকে সমান । তবে শারীরিক গঠন ও মানসিক ধ্যান-ধারণা বা চিন্তাধারার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, যা আমরা প্রত্যেকেই জানি ও স্বীকার করি । এই ভিন্নতা সৃষ্টিকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে, মানুষকে করে তুলেছে পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক বা সহায়ক ।

মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে একক সত্তার অধিকারী বা স্বতন্ত্র । মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে । আমরা আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনায় অনন্য । পুরুষ বা নারী বলে কেউ ছোট বা বড়--তা নয় । তেমনিভাবে কোন এক শ্রেণির মানুষ কম বুদ্ধিমান আবার আর এক শ্রেণির মানুষ বেশি বুদ্ধিমান, এক শ্রেণি উঁচু স্তরের আবার এক শ্রেণি নিচু স্তরের--তা নয়। মানুষ হিসেবে মর্যাদার মাপকাঠিতে আমরা পুরুষ ও নারী সবাই সমান ।

নারী পুরুষের অসমতার ধারণা

অনেকে মনে করেন, ঈশ্বর আদমের পাঁজর থেকে হবাকে সৃষ্টি করেছেন বলে পৃথিবীতে নারীজাতি দ্বিতীয় শ্রেণির । ফলে পুরুষ সব সময় নারী জাতির ওপর তার সব ক্ষমতা, প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে থাকবে অর্থাৎ নারী জাতিকে সব সময় হেয় জ্ঞান করবে, এমনটি হওয়া ন্যায্যতার প্রকাশ নয় । অন্য একটি বিষয় হলো পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থা । আমাদের দেশে পুরুষশাসিত সমাজ-ব্যবস্থার কারণে এক শ্রেণির পুরুষ সব সময় নারীদেরকে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে আসছে। ফলে তাদের সুবিধা আদায়ের জন্য নারী জাতিকে ঘরকোণো করে নিজেদের আয়ত্বে রাখতে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ন্যায় একটি উন্নয়নশীল দেশে এর প্রভাব প্রকট । ফলে নারী বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজালে দিনের পর দিন নিষ্পেষিত হচ্ছে।

ছকপূরণ : নারী ও পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্যসমূহ ও তার দূরীকরণের উপায়সমূহ নির্ণয় কর (প্রয়োজনে ঘরের লাইন বাড়ান যেতে পারে)

 

ভালোবাসা ও সাধু পলের শিক্ষা

প্রভু যীশু খ্রিষ্ট এই জগতে এসেছেন মানুষের মাঝে ঈশ্বরের ভালোবাসার পরিচয় তুলে ধরতে ও এর বিস্তার ঘটাতে । তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত--সর্ব স্তরের মানুষকে ভালোবেসেছেন ও কাছে টেনে নিয়েছেন। যারা তাঁকে ভালোবেসেছে তিনি শুধু তাদেরই ভালোবাসেননি । তিনি তাঁর শত্রুদেরকেও ভালোবেসেছেন, তাদের ক্ষমা করেছেন ও প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি

নিজে ভালোবেসে আমাদেরকে ভালোবাসার মানুষ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ।

ভালোবাসা কী?

সাধু পৌল করিন্থীয়দের কাছে তাঁর প্রথম পত্রে ভালোবাসা সম্পর্কে আমাদেরকে একটা পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন । আমরা খুব বড় মাপের দানশীল মানুষ হতে পারি বা খুব জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান হতে পারি অথবা খুব সুন্দর সুন্দর কথা মানুষের ভাষায় বা স্বর্গদূতদের ভাষায় বলতে পারি । কিন্তু আমাদের অন্তরে যদি ভালোবাসা না থাকে তাহলে সাধু পৌলের কথা অনুসারে আমরা কিছুই নই । অর্থাৎ ভালোবাসা না থাকলে আমাদের কোন মূল্যই নেই । তাঁর কথানুসারে ভালোবাসা হলো:

“আমি যদি মানুষের ও স্বর্গদূতদের ভাষায় কথা বলতে পারি, অথচ আমার অন্তরে যদি ভালোবাসা না থাকে, তাহলে আমি ঢং ঢঙানো কাঁসর বা ঝনঝনে করতাল ছাড়া আর কিছুই নই! আর আমি যদি প্রাবক্তিক বাণী ঘোষণা করতে পারি, যদি উপলব্ধি করতে পারি সমস্ত রহস্যাবৃত সত্য, জানতে পারি ধর্মজ্ঞানের সমস্ত কথা, যদি আমার অন্তরে থাকে পর্বত সরিয়ে দেবার মতো পূর্ণ বিশ্বাস, অথচ অন্তরে না থাকে ভালোবাসা, তাহলে আমি তো কিছুই নই!. . . আর আমি যদি আমার অন্তরে সমস্ত কিছুই দীনদরিদ্রের মধ্যে বিলিয়ে দিই, এমন কি আমার নিজের দেহ-ও আগুনে সঁপে দেই, অথচ আমার অন্তরে যদি না থাকে ভালোবাসা, তাহলে তাতে আমার কোন লাভই নেই” (১করি ১৩:১-৩)।

সাধু পলের মতে, ভালোবাসার মধ্যে কোন অসহিষ্ণুতা, নিষ্ঠুরতা, হিংসাবিদ্বেষ, রুক্ষতা ইত্যাদি থাকতে পারে না । তিনি বলেন :

“ভালোবাসা নিত্য-সহিষ্ণু, ভালোবাসা স্নেহকোমল । তার মধ্যে নেই কোন ঈর্ষা । ভালোবাসা কখনো বড়াই

করে না, উদ্ধতও হয় না, রুক্ষও হয় না । সে স্বার্থপর নয়, বদমেজাজীও নয়। পরের অপরাধ সে কখনো

ধরেই রাখে না । তার বিশ্বাস সীমাহীন, সীমাহীন তার আশা ও তার ধৈর্য” (১করি ১৩: ৪-৭)।

সাধু পল তিনটি ঐশগুণের কথা তুলে ধরেন । গুণগুলো হলো: বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা । কারণ আমরা প্রত্যেকে ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রয়োজন অনুসারে এই তিনটি গুণ বা দান পেয়েছি । এই গুণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রধানটি হলো ভালোবাসা । তিনি বলেন:

“ভালোবাসার মৃত্যু নেই । প্রাবক্তিক বাণী ঘোষণা? তা তো একদিন মূল্যহীন হয়ে যাবে । অজ্ঞাত ভাষায় কথা বলা? তা তো একদিন শেষ হয়ে যাবে। ধর্মীয় জ্ঞান? তা-ও তো মূল্যহীন হয়ে যাবে, কারণ আমাদের সমস্ত জানা-ই যে অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ আমাদের সমস্ত প্রাবক্তিক বাণী ঘোষণা । কিন্তু যা পূর্ণ, তা যখন আসবে, তখন যা-কিছু অসম্পূর্ণ, তা সবই অসার হয়ে যাবে । আপাতত বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা, এই তিনটিই থেকে যাচ্ছে বটে কিন্তু ভালোবাসাই সর্বশ্রেষ্ঠ” (১করি ৮-১০, ১৩)।

 

 

 

ভালোবাসা সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা যায় । বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন । তবে ভালোবাসা সম্পর্কে বলতে পারা বা ব্যাখ্যা করতে পারাই সব কিছু নয় । ভালোবাসা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারা হলো মুখ্য বিষয় । ভালোবাসা হলো পবিত্র । এখানে কখনো কোন শর্ত থাকে না । বরং শর্তহীন ভাবে হৃদয়ের টানে যখন পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি আসে, পরস্পরের কথা চিন্তা করে, পরস্পরের মঙ্গল কামনা করে তা-ই প্রকৃত ভালোবাসা । ভালোবাসা মানুষকে মহান করে তোলে ।

কাজ: খ্রিষ্টের শিক্ষানুসারে কীভাবে পরস্পরের সাথে সুস্থ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়া যায় তা দলে আলোচনা কর ।

নীতিভ্রষ্ট মানুষের মন পরিবর্তনের প্রতি যীশুর শিক্ষা

যীশুর সংস্পর্শে এসে এক পাপী নারী ভক্তিপ্রাণা হয়ে উঠল : (লুক ৭:৩৬-৫০)

একদিন ফরিসিদের একজন যীশুকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন । সেই ফরিসির বাড়িতে এসে যীশু খাবার আসনে বসলেন । সেই সময়ে একটি মেয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলো; শহরে সে পাপের জীবন যাপন করত । যীশু ফরিসিদের বাড়িতে খেতে বসেছেন শুনে সে সাদা ফটিকের একটি পাত্রে করে সুগন্ধি তেল নিয়ে এসেছিল । যীশুর পেছনে তাঁর পায়ের কাছে এসে সেখানেই সে বসে রইল; সে কাঁদছিল; যীশুর পা দুইখানি তার চোখের জলে ভিজে যেতে লাগল । সে তখন নিজের মাথার চুল দিয়ে তাঁর পা দুইটি মুছিয়ে তা চুম্বন করল আর সেই সুগন্ধি তেল তাতে মাখিয়ে দিল । তাই দেখে যে-ফরিসি যীশুকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তিনি মনে মনে বলতে লাগলেন: ‘লোকটা প্রবক্তা হলে তো বুঝতেই পারত, যে-মেয়ে এখন ওকে স্পর্শ করছে, সে কে, কেমন-ধারা মেয়ে । বুঝতেই পারত, সে একটা পাপিনী!”

তখন তাঁর এই মনের চিন্তার উত্তর দিতে গিয়ে যীশু বললেন: ‘সিমোন, আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে!' তিনি উত্তর দিলেন: “বলুন গুরু!” যীশু বললেন: ‘এক মহাজনের কাছে দুইজন লোকের ঋণ ছিল: একজনের দেনা ছিল পাঁচ শো রূপোর টাকা আর একজনের পঞ্চাশ রূপোর টাকা । তাদের শোধ করার ক্ষমতা না থাকায় মহাজন দুইজনেরই দেনা মাপ করে দিল ।

এখন বলুন, এই দুইজনের মধ্যে কে মহাজনটিকে বেশি ভালোবাসবে ?' সিমোন উত্তর দিলেন: ‘আমার তো মনে হয়, মহাজন যার বেশি দেনা মাপ করেছে, সে-ই তাকে বেশি ভালোবাসবে!” যীশু বললেন: “ঠিক কথাই বলেছেন ।' তারপর সেই মেয়েটির দিকে ফিরে তিনি সিমোনকে বললেন: ‘আপনি এই মেয়েটিকে দেখছেন তো ? আমি আপনার বাড়িতে এলাম, অথচ আপনি আমাকে পা ধোবার জল দিলেন না । এই মেয়েটি কিন্তু তার চোখের জলে আমার পা দু'টো ভিজিয়ে দিল: মুছিয়ে দিল নিজের চুল দিয়েই । আপনি তো আমাকে চুম্বন করে স্বাগত জানালেন না; এ কিন্তু আমি এখানে আসার সময় থেকেই আমার পা দুইটাতে চুম্বন করেই চলছে! আপনি তো আমার মাথায় একটু তেল মাখিয়ে দিলেন না; এ কিন্তু আমার পায়ে সুগন্ধি তেল মাখিয়ে দিল! তাই আমি আপনাকে বলছি, এর পাপ, এর যে-বহু পাপ, তা ক্ষমা করাই হয়েছে । এর এতখানি ভালোবাসাই তো সেই ক্ষমার প্রমাণ । যাকে অল্প ক্ষমা করা হয়, সে অল্পই ভালোবাসে।' তারপর তিনি মেয়েটিকে বললেন: ‘তোমার পাপ ক্ষমা করাই হয়েছে!' যারা সেখানে তাঁর সঙ্গে খেতে বলেছিল, তারা মনে মনে বলতে লাগল: ‘কে এই লোক, যে কিনা পাপও ক্ষমা করে ?' যীশু তখন মেয়েটিকে বললেন: ‘তোমার বিশ্বাসই তোমাকে উদ্ধার করেছে! এবার যাও তুমি, শান্তিতেই থাক!”

উপরের শাস্ত্রাংশে দেখতে পাই যে ঐ মেয়েটি যে পাপী ছিল তা সকলেই জানত । মেয়েটি যীশুকে স্পর্শ করলে লোকে মন্দ বলবে তা জেনেও যীশু মেয়েটিকে কিছু বলেননি । মেয়েটি তাঁর পা স্পর্শ করেছে । শেষে তিনি

 

 

পুরুষ ও নারী

মেয়েটিকে বললেন, ‘তোমার পাপ ক্ষমা করাই হয়েছে!' যীশুকে কি অস্বাভাবিক বলে মনে হয় ? অন্যেরা এ ধরনের মেয়েকে যেভাবে দেখে যীশু কেন সেভাবেই দেখেননি? এ ধরনের মানুষের প্রতি আমার মনোভাব কেমন ? আমি কি শিষ্টাচারী ? আমি কি নিজের পবিত্রতা বা সদগুণের জন্য গর্বিত বা অহংকারী? আমি কার দলে--যীশুর না ফরিসিদের ? তিনি শুধু অনুতাপীদেরই ক্ষমা করেন । আমরা সকলেই যীশুর ক্ষমা পেতে পারি ।

অনুশীলনী

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. ঈশ্বর আদমের পাঁজর দিয়ে কাকে বানালেন ?

ক. মারীয়াকে

খ. যীশুকে

গ. হবাকে

ঘ. সাধু যোসেফকে

2. মানুষের একা থাকা ভালো নয় কারণ তার-

i. সঙ্গীর প্রয়োজন

ii. সাহায্যের প্রয়োজন

iii. ত্যাগের প্রয়োজন

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i

খ. i ও ii

গ. i ও iii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :

অপূর্ব বিদেশে থাকেন । প্রায়ই তিনি টেলিফোনে তার স্ত্রী বিথির সাথে কথা বলেন। তিনি তার স্ত্রীকে এতই ভালোইবাসেন, যে কারণে তিনি বেশিদিন বিদেশে না থেকে স্বদেশে চলে আসেন ।

৩. স্ত্রীর সাথে অপূর্বের কথা বলার মধ্য দিয়ে কী প্রকাশ পায় ?

ক. কঠোর মনোভাব

খ. সচেতন সম্পর্ক

গ. ভাবের আদান-প্রদান

ঘ. সামাজিকতা

৪ । অপূর্ব ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে-

ক. সরলতা

খ. শিল্প নৈপুণ্য

গ. ভালো সম্পর্ক

ঘ. শ্রদ্ধা ও ভক্তি

 

 

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১. ঈশ্বর মানুষকে নারী ও পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন কেন ?

২. নারী-পুরুষের মধ্যে সু-সম্পর্ক রাখা উচিত কেন ?

৩.  নারী-পুরুষের সমতা বলতে কী বোঝায় ? ৪. ভালোবাসা সম্পর্কে সাধু পলের শিক্ষা কী ?

৫. নারী-পুরুষকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয় কেন ?

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. অরুণ ও রুনা একে অপরকে ভালোবাসে । দুইজনই দুইজনকে খুব উপলব্ধি করে । প্রতিদিন তারা দেখা করে কথা বলে । নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে । তাদের মধ্যে পবিত্র ভালোবাসার সম্পর্ক চলছে। তবে অরুণ রুনাকে এতই ভালোবাসে যে সে রুনাকে খুব কাছে পেতে চায়। রুনাও অরুণকে ভীষণ ভালোবাসে । তবে তার পারিবারিক এবং ধর্মীয় সুশিক্ষা দ্বারা রুনা বৃদ্ধি লাভ করেছে। এজন্য সে ভালোবাসার পবিত্রতা সম্পর্কে অরুণকে বোঝাতে সক্ষম হয় ।

ক. ঈশ্বর মানুষকে কততম দিনের সৃষ্টি করেছেন ?

খ. ঈশ্বর মানুষকে তার প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করলেন কেন ?

গ. অরুণ ও রুনার মধ্যে যীশুর কী ধরনের শিক্ষা বিদ্যমান - ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. ধর্মীয় ও পারিবারিক সুশিক্ষা রুনার মাধ্যমে অরুণ গ্রহণ না করলে তাদের সম্পর্কের পরিণতি কী হতে পারে- তা বিশ্লেষণ কর ।

জলি ও তুলি পাড়া প্রতিবেশী এবং বান্ধবী । তারা দুইজনে যে কোন জায়গায় একত্রে যায়, একত্রে থাকে । তারা দুইজন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে একজন আরেকজনের বিপদে আপদে সবসময় পাশে থাকবে । তুলিদের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না বলে জলি তাকে প্রায়ই সাহায্য সহযোগিতা করত যেন তুলির লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সমস্যা না হয় । একদিন দুই বান্ধবী রাস্তায় চলার সময় ছিনতাইকারীরা তাদেরকে আটক করে ঘিরে ফেলে । ছিনতাইকারীরা জলির গলা থেকে মূল্যবান স্বর্ণের গহনা খুলে নিতে জোরাজারি করছিল । এমতাবস্থায় জলির বিপদে পাশে না থেকে তুলি নিজে বিপদমুক্ত হতে ঐ স্থান ছেড়ে চলে গেল ।

ক. সাধু পল কয়টি ঐশগুণের কথা তুলে ধরেন ?

খ. বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসার মধ্যে ভালোবাসা প্রধান কেন ?

গ. জলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ভালোবাসার কোন শিক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে – বর্ণনা কর ।

ঘ. তুলির আচরণ পরিবর্তন না করলে তার পরিণতি কেমন হবে বলে তুমি মনে কর? তোমার মতামত ব্যক্ত কর ।

Content added By

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

সৃষ্টিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে
মানুষকে করেছে পরস্পরের পরিপূরক
নারী-পুরুষকে দিয়েছে ভিন্ন মর্যাদা
সৃষ্টির উপর কর্তৃত্ব করতে
Promotion